ইয়াসিন হাসান: জয়ের শেষ রান নিলেন অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুস। দরকার ছিল ১, ম্যাথুস মারলেন বাউন্ডারি। তাতে দল জিতেছে, পূর্ণ হয়েছে তার হাফ সেঞ্চুরিও। ব্যাট উঁচিয়ে উদযাপন করলেন। সঙ্গী কুশল মেন্ডিসের মুখে চওড়া হাসি।
এক ম্যাচ হাতে রেখে ৪৪ মাস পর দেশের মাটিতে দ্বিপক্ষীয় ওয়ানডে সিরিজ জয়ের আনন্দ এমন হবে, সেটাই স্বাভাবিক। ড্রেসিংরুমের উদযাপন অবশ্য শুরু হয়েছিল আগেই। বাংলাদেশের দেওয়া ২৩৯ রানের লক্ষ্য স্বাগতিকরা ছুঁয়ে ফেলে ৭ উইকেট হাতে রেখে, ৩২ বল আগে।
কাভারে থাকা তামিম ইকবাল নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে। রাতের খোলা আকাশের জ্বলজ্বলে তারাগুলোও তার মুখে হাসি ফোটাতে পারছিল না। প্রেমাদাসার বিশাল মাঠ ছেড়ে ড্রেসিংরুমে যাওয়ার পথটা তার কাছে লাগছিল অনন্ত, এই পথ যেন শেষ হতে চায় না! তার অধিনায়কত্বে দল হারল আরেকটি ম্যাচ। নিজেও রান পাননি। এতটা বিমর্ষ, বিধ্বস্ত তাকে দেখা যায়নি কখনোই।
প্রায় যেন প্রথম ম্যাচেরই পুনরাবৃত্তি। এবার আগে ব্যাট করে খুব বড় চ্যালেঞ্জ দিতে পারল না বাংলাদেশ। রান তাড়ায় শ্রীলঙ্কা উড়িয়ে দিল সফরকারীদের। ম্যাচের পোস্টমর্টেম কী হবে আর? ওই প্রথম ম্যাচের মতোই। দ্বিতীয় ওয়ানডের আগে যেন সব প্রথম ম্যাচের খাতা রিভিশন করে নেমেছিল গোটা দল। ব্যাটিং কিংবা বোলিং- শুরুতেই বিধ্বস্ত বাংলাদেশ। এরপর লড়াই চালালেও শেষ হাসি হাসা হয় না।
কেবল একজন পারফরমার জিতেছেন সবার মন। পেয়েছেন করতালি। তিনি মুশফিকুর রহিম। চাপের ভেতর থেকেও যেভাবে ব্যাট হাতে দোর্দন্ড প্রতাপ দেখিয়েছেন তাতে মেন্ডিস, করুনারত্নরাও বলেছেন, ‘ওয়েল প্লেইড।’ তার ৯৮ রানের ঝকঝকে ইনিংসের পরও বাংলাদেশ ব্যাকফুটে। তবুও মর্ডান ক্রিকেটে ২৪০-এর মতো পুঁজি নিয়েও প্রতিপক্ষকে আটকে রাখার মিশনে নামে বোলাররা। কিন্তু বাংলাদেশের সেই চেষ্টাও যেন নেই! তাইতো শ্রীলঙ্কা প্রথম ১০ ওভারে তুলে নেয় বিনা উইকেটে ৬৯ রান। তরুণ আভিসকা ফার্নান্দো চাপ গায়ে মাখান না। ৭৫ বলে ৯ চার ও ২ ছক্কায় করেন ৮২ রান। অধিনায়ক করুণারত্নে ভালো শুরুর পরও মিরাজের বলে আটকে যান ১৫ রানে। কুশল পেরেরা ঝড় তোলার আগে ফেরেন ৩০ রানে।
৩ উইকেট তুলে নিয়ে মাঝের ওভারগুলোতে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস দেন তাইজুল, মিরাজ, মুস্তাফিজরা। কিন্ত অভিজ্ঞ ম্যাথুস যখন ঠান্ডা মস্তিষ্ক নিয়ে ক্রিজে থাকেন, তখন জয় শ্রীলঙ্কা পাবে সেটাই অনুমিত। সাথে ধ্রুপদী কুশল মেন্ডিস থাকলে জয় হয়ে ওঠে হাতের মোয়া। তেমনটাই হলো। ১২০ বলে তাদের ৯৬ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটিতে লঙ্কানরা পৌঁছে যায় জয়ের বন্দরে।
অথচ পুরো দিনটিই হতো পারত বাংলাদেশের। টস জিতে তামিম ব্যাটিং নিতে ভুল করেননি। অনেকটা মন্থর উইকেটে সতর্ক হয়ে খেলতে হতো বাংলাদেশকে। কিন্তু শুরু থেকেই সবকিছু ওলটপালট। যে ফুলটস বল পেলে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতেন সৌম্য, সেই ফুলটসে এখন উইকেট বিলিয়ে আসেন এলবিডব্লিউ হয়ে। তামিম নিজের দিনে যে বল ড্রাইভ করে পয়েন্ট ও কাভারের মাঝ দিয়ে বাউন্ডারিতে পাঠান, সেই বল এখন ভেতরে টেনে বোল্ড হন। কী আশ্চর্য, টানা ছয় ইনিংসে দেশসেরা ওপেনারের উইকেট উপড়ে ফেলেন বোলাররা।
মিথুন হতে চান সাকিব। কিন্তু পারেন না। উইকেট উপহার দেন যাচ্ছেতাইভাবে। মাহমুদউল্লাহ দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়ে বোল্ড হন আনকোড়া শট খেলতে গিয়ে। দুজনের উইকেট পেয়েছেন স্পিনার আকিলা ধনঞ্জয়া।
একদিন আগেও সাব্বির-মুশফিকের জুটি হয়ে উঠেছিল আস্থার সবচেয়ে বড় নাম হয়ে। আজও তাদের দিকে তাকিয়ে ছিল দল। কিন্তু দুজনের ভুল বোঝাবুঝিতে সব ওলটপালট। ৮৮ রান তুলতেই ৫ ব্যাটসম্যান সাজঘরে। সবশেষ বাংলাদেশ ক্রিকেটে এমন দুর্দশা নেমেছিল পাঁচ মাস আসে, নিউজিল্যান্ডের মাটিতে। ৬১ রানে ৫ ব্যাটসম্যান সাজঘরে। সেদিন লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে সাব্বির পেয়েছিলেন সেঞ্চুরি। সাইফউদ্দিন আর মিরাজ ছিলেন সাপোর্টিং রোলে।
কলম্বোতে আজ সাব্বিরের ভূমিকায় মুশফিক। নাহ, মুশফিক ক্যারিয়ারের অষ্টম সেঞ্চুরি পাননি। ৯৮, নট আউট। দলীয় স্বার্থে বিসর্জন দেওয়া সেঞ্চুরির আক্ষেপে মুশফিক পুড়ছেন না নিশ্চিত। কারণ তার বুক চিতিয়ে লড়াই করা ৯৮ রানের ইনিংসই তো মান বাঁচিয়েছে দলের। সেদিনের মতো আজও হেসেছে মিরাজের ব্যাট। ডানেডিনে সাব্বিরের সেঞ্চুরির দিনে মিরাজ করেছিলেন ৩৭, আজ হাফ সেঞ্চুরির কাছে গিয়ে আউট হন ৪৩ রানে। মুশফিক-মিরাজের ব্যাটে রক্ষা বাংলাদেশের। তাদের ৮৪ রানের জুটিতে বাংলাদেশ পায় দুইশর ছোঁয়া।
বাংলাদেশের পুঁজি কত হবে, তা নির্ভর করছিল মুশফিক কতক্ষণ ক্রিজে থাকেন তার ওপর। চাইলেই পাগলাটে কয়েকটি শট খেলতে পারতেন। দ্রুত রান তোলার তাড়ায় মনোযোগ নষ্ট করতে পারতেন। কিন্তু দলের সেরা ব্যাটসম্যান তেমন কিছুই করলেন না। নিজের ওপর আস্থা রেখে দলকে টেনে নিলেন শেষ বল পর্যন্ত। জানতেন ইনিংসের শেষ পর্যন্ত থাকলে ২৪০-২৫০ রানের মতো অন্তত হবে! সেই চিন্তায় তার দৃঢ়চেতা ব্যাটিং। তাতে ২ রানের জন্য সেঞ্চুরি হয়নি ঠিকই, কিন্তু দলীয় সংগ্রহে ১-২ রান যোগ হওয়ার মর্মটা তার থেকে ভালো আর কে জানেন!
আগের ম্যাচে ৬৭ করা মুশফিকের তিন অঙ্ক ছুঁতে শেষ ওভারে দরকার ছিল ৫ রান। তিন বার স্ট্রাইক পেয়ে ৩ রানের বেশি করতে পারেননি উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান। ১১০ বলে ৬ চার ও ১ ছক্কায় সাজান তার বীরত্বগাঁথা ৯৮ রানের ইনিংসটি। সেঞ্চুরি না পেলেও এ ইনিংস খেলার পথে ওয়ানডেতে তামিম ও সাকিবের পর তৃতীয় বাংলাদেশি ক্রিকেটার হিসেবে ছুঁয়েছেন ৬ হাজার রানের মাইলফলক।
মুশফিক লড়াইয়ের পুঁজি এনে দিয়েছিলেন। প্রয়োজন ছিল নতুন বলে নিয়ন্ত্রিত এবং আগ্রাসী বোলিং। সাথে দুর্দান্ত ফিল্ডিং। কিন্তু ব্যাটসম্যানদের পাশাপাশি বোলাররাও রয়ে গেলেন অন্ধকারে। ফিল্ডিংয়েও সাদামাটা বাংলাদেশ। ফলাফল, সিরিজে ২-০ তে পিছিয়ে সফরকারীরা। সিরিজ হাতছাড়া হওয়ার পর এবার হোয়াইটওয়াশ এড়ানোর চ্যালেঞ্জ তামিমের দলের সামনে।