এ বছর শোকাবহ আগস্ট শুরু হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী সামনে রেখে। এক শতাব্দী আগে তৎকালীন বাংলার এক প্রত্যন্ত পল্লীতে জন্মগ্রহণ করেও তিনি কীভাবে পরবর্তী সময়ে গোটা উপমহাদেশের রাজনৈতিক মানচিত্র বদলের মহানায়কে পরিণত হয়েছিলেন, গোটা বিশ্ব জানে।
বাংলাদেশে কেবল নয়, বিশ্বজুড়েই মহাকালের পরিক্রমায় আমরা কত মহানায়ককে ফিকে হয়ে যেতে দেখেছি! একসময় গোটা বিশ্ব নাড়িয়ে দেওয়া ভদ্মাদিমির ইলিচ লেনিন কিংবা মাও সে তুং কালের বিবর্তনে আজ নিজ নিজ দেশেই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছেন। নিজেদের প্রতিষ্ঠিত দেশ আজ তাদের আদর্শের বিপরীত স্রোতে চলছে। সেদিক থেকে বঙ্গবন্ধু তার স্বাতন্ত্র্যে সমুজ্জ্বল। যত দিন যাচ্ছে, বঙ্গবন্ধু যেন আমাদের জাতীয় জীবনে ততই বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন। জন্মের একশ’ বছরে এসে রাষ্ট্র ও জাতি গঠনের প্রশ্নে আমাদের বারবার ফিরে যেতে হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর কাছেই।
একাত্তরে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম কেবল বাঙালি জাতির জীবনেই অনন্য ঘটনা ছিল না; বিভিন্ন মোড়ল রাষ্ট্রের সবরকম অন্যায্য জাল ছিন্ন করাও ছিল তৎকালীন বিশ্বব্যবস্থায় এক বড় ঘটনা। বঙ্গবন্ধুও কেবল একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জনক হিসেবে নিজেকে সীমিত রাখেননি। তিনি উদাত্ত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘বিশ্ব দুই ভাগে বিভক্ত- শোষক ও শোষিত। শেখ মুজিব শোষিতের পক্ষে।’ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্যও বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেছিলেন অবিনাশী প্রেরণা। হতে পারে, তার এই অবস্থান আন্তর্জাতিক শোষকগোষ্ঠী ভালোভাবে নেয়নি। যে কারণে আমরা দেখি, পঁচাত্তরের পনেরো আগস্টের সেই মর্মন্তুদ ঘটনায় দেশীয় বিপথগামীদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক চক্রান্তকারীরাও যুক্ত হয়েছিল।
সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ পুনর্গঠনে আত্মনিয়োগের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, দেশদ্রোহীদের বিরুদ্ধেও সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করেছিলেন। ১৯৭২-৭৫ সালে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর অনেক ভাষণেই দেখা যাবে, তিনি প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করছেন। বলছেন, বড় বড় চেয়ারে বসে সাধারণ নাগরিকদের অবজ্ঞা-অবহেলা করা যাবে না। দেশের সামরিক-বেসামরিক আমলা, চিকিৎসক, প্রকৌশলীরা যে খেটে খাওয়া মানুষের ঘাম ঝরানো অর্থেই ‘শিক্ষিত’ হয়েছেন, সেটা বারবার মনে করিয়ে দিয়েছেন। কৃষক ও শ্রমিকের স্বার্থ যাতে কোনোভাবে ক্ষুণ্ণ না হয়, সেজন্য তিনি কড়া নজর রেখেছেন।
আমাদের দুর্ভাগ্য, বঙ্গবন্ধু তার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার কাজ সম্পন্ন করে যেতে পারেননি। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য তিনি সারাজীবন যে সংগ্রাম করেছেন, তার পরিণতি দেখে যেতে পারেননি। যে জাতির জন্য নিজের জীবন ও যৌবন অন্ধকার কারাপ্রকোষ্ঠে ব্যয় করেছেন, সেই জাতিরই কিছু কুলাঙ্গার সন্তান তাকে হত্যা করেছিল। আমাদের সৌভাগ্য, বঙ্গবন্ধুরই কন্যা, সেই সূর্যালোকে উদ্ভাসিত নেতৃত্ব, শেখ হাসিনা পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে রাজনীতিতে এসেছিলেন।
আমরা নিশ্চিত, ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে শারীরিকভাবে হত্যা করতে সক্ষম হলেও তার আদর্শকে হত্যা করতে পারেনি। বরং পঁচাত্তর-পরবর্তী অন্ধকার যুগ পেরিয়ে যত দিন যাচ্ছে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে ততই উদ্ভাসিত হচ্ছে বাংলাদেশ। বিলম্বে হলেও কেবল জাতির পিতার হত্যার বিচার হয়নি; যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়নি; দেশও ফিরেছে রক্তস্নাত মুক্তিযুদ্ধের ধারায়। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চার মেয়াদে শেখ হাসিনা দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর কাজটিই করে যাচ্ছেন নিরলসভাবে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের গত নির্বাচনের ইশতেহারেই বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নীতি ও কর্মসূচির অভিমুখ স্পষ্ট- ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী সামনে রেখে এখনকার কর্তব্য হচ্ছে, বাংলাদেশের সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় সব নাগরিককে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া। বঙ্গবন্ধু যে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির স্বপ্ন দেখতেন- তার মূলে ছিল ‘মানবকেন্দ্রিক উন্নয়ন’। তার ভাষায়- ‘দুঃখী মানুষের’ মুখে হাসি ফোটানো। বঙ্গবন্ধুর নামে কেবল বক্তৃতা করে, অনুষ্ঠান করে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা যাবে না। বঙ্গবন্ধু যে আমলাতন্ত্রের, উন্নাসিক রাজনীতির, অসংবেদনশীল পেশাজীবীতার বিরুদ্ধে ছিলেন; সেই প্রবণতা বাংলাদেশে এখনও রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পূর্ণ বাস্তবায়নে এদের থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে হবে। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে সবার সমান মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে।
সবচেয়ে বড় কর্তব্য আমি মনে করি, বঙ্গবন্ধুকে তরুণ প্রজন্মের কাছে নিয়ে যেতে হবে। বঙ্গবন্ধুকে সরাসরি দেখেছেন, দেশে এমন মানুষের সংখ্যা ক্রমে কমছে। বঙ্গবন্ধুর নীতি ও আদর্শ চর্চা করেছেন, এমন মানুষের সংখ্যাও কমছে। দেশ আবার মুক্তিযুদ্ধের ধারায় ফিরে আসায় বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে অপপ্রচারের অন্ধকার হয়তো দূর হয়েছে; কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নীতি ও আদর্শ সম্পর্কে নতুন প্রজন্মকে জানানোর দায়িত্ব কয়জন পালন করছেন? বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ সামনে রেখে, শোকের এই আগস্টে, সেই তাগিদই আমি দিয়ে যেতে চাই।
আমি মনে করি, বঙ্গবন্ধুর জীবন, কর্ম, বাণী সম্পর্কে নিবিড়ভাবে নতুন প্রজন্মকে জানানো এখনকার কর্তব্য। আমরা থাকব না, কিন্তু বঙ্গবন্ধু আমাদের হাতে আদর্শের যে মশাল তুলে দিয়ে গেছেন, তা যেন নতুন প্রজন্মের কাছে সাফল্যের সঙ্গে পৌঁছে দিতে পারি।