Home টপ নিউজ যেভাবে পৃথিবীকে বদলে দিয়েছে মশা

যেভাবে পৃথিবীকে বদলে দিয়েছে মশা

 

মশাবাহিত রোগ নিয়ে গবেষণা করে চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছেন ইতিহাসবিদ টিমোথি সি উইনেগার্ড। তার গবেষণা বলছে, পৃথিবীর ইতিহাসই বদলে দিয়েছে মশা। শুধু তাই নয়, উইনেগার্ডের মতে, আধুনিক গণতন্ত্রেরও জনক ‘মশা’! কিন্তু কীভাবে এটি সম্ভব? নিউ ইয়র্কার অবলম্বনে লিখেছেন পরাগ মাঝি

একটি স্কটিশ অভিযানের গল্প

১৬৯৮ সাল। স্কটল্যান্ড থেকে পাল তুলেছে পাঁচটি জাহাজ। এর মধ্যে একটি জাহাজে নানা রকমের পণ্য বোঝাই। এসব পণ্যের মাঝে আছে পশমি মোজা, কম্বল, পরচুলা, ঝিনুকের চিরুনি, বাইবেল এবং ২৫ হাজার জোড়া চামড়ার জুতা। শুধু তাই নয়, এসবের মধ্যে একটি প্রিন্টিং প্রেসও রয়েছে। এই নৌবহরে থাকা ১২শ উপনিবেশকারী হয়তো সামনের দিনগুলোতে নতুন জায়গায় ব্যবসা-বাণিজ্য এবং চুক্তি-সন্ধির মাধ্যমে খুবই ব্যস্ত সময় কাটাতে যাচ্ছে। এই নৌবহরের গন্তব্য পানামার দারিয়ান অঞ্চল। এই অঞ্চলেই একটি ব্যবসায়িক কেন্দ্র করতে চায় স্কটল্যান্ডের ওই কোম্পানিটি। কারণ সেখান থেকেই একটি সরু সংযোগ ভূখ- দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের মতো একটি বিশাল ভূখ-কে যুক্ত করেছে। পৃথিবীর বড় বড় সব মহাসাগরেরও সংযোগস্থল এই অঞ্চলটি। আগের বছরগুলোতে দুর্ভিক্ষ মোকাবিলা করা স্কটল্যান্ডের ভাগ্যোন্নয়নে এটি ছিল একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনা দেশটির বড় বড় বিনিয়োগকারীদের দারুণভাবে আকৃষ্ট করেছিল। ধারণা করা হচ্ছিল, দেশটির অর্থনৈতিক সংস্থানের অন্তত এক-চতুর্থাংশ পানামা অঞ্চলের ব্যবসা থেকেই আসবে।

ভাগ্যোন্নয়নের জন্য ওই স্কটিশ অভিযাত্রা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো। কারণ পানামায় গিয়ে উপনিবেশকারীরা গণহারে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। পিতজ্বর এবং ম্যালেরিয়া আক্রান্ত হয়ে ওই দলটির প্রতিদিন গড়ে অন্তত ১২ জন করে মারা যাচ্ছিল। ঐতিহাসিক টিমোথি সি উইনেগার্ড তার ‘দ্য মসকুইটো : এ হিউম্যান হিস্টোরি অফ আওয়ার ডেটলিয়েস্ট প্রিডেটর’ বইয়ে দাবি করেছেন, বিভিন্ন ডায়েরি, চিঠি এবং নথিপত্রে দেখা গেছে, স্কটিশ উপনিবেশকারীদের কাছে সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত হয়ে হাজির হয়েছিল মশা নামে ক্ষুদ্র প্রাণীটি। মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই স্কটিশ অভিযাত্রীদের দলটি অর্ধেক হয়ে গিয়েছিল। যারা সুস্থ ছিল তারা কোনোক্রমে তাদের জাহাজে ফিরে গিয়েছিল এবং উত্তরের দিকে রওনা হয়েছিল। পালিয়ে যাওয়া দলটি তাদের অনেক সঙ্গীকেই সমুদ্রের তীরে ফেলে এসেছিল। তাদের শরীরে জাহাজে ওঠার মতো শক্তিটুকুও আর অবশিষ্ট ছিল না। জাহাজে করে যারা পালিয়ে যাচ্ছিল তাদের মধ্যেও দলে দলে জ্বরে আক্রান্ত হলো। শেষ পর্যন্ত অসুস্থ সঙ্গীদের জলে নিক্ষেপ করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না ভীতসন্ত্রস্ত দলটির। একটি সাহায্যকারী দল যখন দারিয়ানে পৌঁছল তারা তীরের মধ্যে কেবল প্রিন্টিং প্রেসটিকে পরিত্যক্ত অবস্থায় আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছিল।

মশার ঐতিহাসিক ভূমিকা

ঐতিহাসিক উইনেগার্ড বিভিন্ন অভিযান এবং উপনিবেশ সংশ্লিষ্ট গল্পগুলোর একটি তালিকা তৈরি করেন। যেখানে দেখা যায়Ñ মশা, জ্বর, ম্যালেরিয়া এবং মৃত্যু এই শব্দগুলোকে কেন্দ্র করেই বেশিরভাগ গল্প আবর্তিত হয়েছে। ইউনেগার্ড মন্তব্য করেছেন, পৃথিবীতে যতদিনে গ্রহাণু বৃষ্টি হয়েছিল তার আগেই মশাবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে ডায়নোসররা বিলুপ্ত হওয়ার কাছাকাছি চলে গিয়েছিল। ম্যালেরিয়া প্রাচীন আফ্রিকাকেও ধ্বংস করে দিয়েছিল। এই রোগটি প্রাচীন গ্রিক এবং রোমানদেরও গণহারে মেরেছিল। এমনকি সে সময়ের বিভিন্ন যুদ্ধের ফলাফলও নির্ধারণ করে দেয় মশা। গ্রিক ফিজিশিয়ান হিপোক্রেটসের বর্ণনায় ম্যালেরিয়া জ্বরের মহামারী সম্পর্কে ধারণা করা যায়। তিনিই প্রথম এই রোগের লক্ষণসমূহের বর্ণনা দেন এবং বছরের কোন সময় এটা হয় ও কোন জায়গায় রোগীরা বাস করে সেই তথ্যের সঙ্গে একটা সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেন।

৯৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে চাইনিজ ইতিহাসবিদ সিমা কিয়ান লিখেছিলেন, ‘ইয়াংজির দক্ষিণ অঞ্চল ছিল অপেক্ষাকৃত নিম্নভূমি এবং স্যাঁতসেঁতে, সেখানকার মানুষ তরুণ অবস্থায়ই মরে সাফ হয়ে গিয়েছিল।’ এর প্রধান কারণ হিসেবে ম্যালেরিয়াকেই দায়ী করা হয়।

উইনেগার্ড বিভিন্ন যুগে মশাবাহিত রোগে মানুষের মৃত্যু সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখেছেন, রোমের কাছাকাছি অঞ্চল পন্টিন মার্শেসকে মৃত্যুর উপত্যকা হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলে ভ্রমণ করতে গিয়ে এক জার্মান পর্যটক লিখেছিলেন, ‘বসন্তে এই অঞ্চল স্বর্গ, গ্রীষ্মে নরক আর শরতে যেন এক হাসপাতাল।’ কলম্বাস পূর্ববর্তী যুগে মায়া সভ্যতার বর্ণনায়ও অস্বাভাবিক মৃত্যুর উল্লেখ পাওয়া যায়।

উইনেগার্ডের তথ্য অনুযায়ী, প্রাচীন রোমের অভিজাতরা পাহাড়ের চূড়ায় তাদের বাড়ি বানাত শুধু মশার অত্যাচার থেকে রেহাই পওয়ার জন্য। এই ধারাবাহিকতা এখনো রয়ে গেছে। প্রচ্ছন্ন এই কারণেই আমেরিকায় পাহাড়ের ওপর যেসব বাড়িঘরÑ সেগুলোর দামও আকাশচুম্বী।

মশার কথা জানত না কেউ

মজার ব্যাপার হলো, ১৮৯৭ সালের আগে মানুষ জানতই না যে, ম্যালেরিয়া রোগটি মশার মাধ্যমে ছড়ায়। সে সময় ভারতে কর্মরত ব্রিটিশ ডাক্তার স্যার রোনাল্ড রস প্রমাণ করেন যে, অ্যানোফিলিস মশা এই রোগের বাহক হিসেবে কাজ করে। এর আগে মানুষ মিয়াজমা তত্ত্বে বিশ্বাস করত। এই তত্ত্ব অনুসারে, মানুষের বিশ্বাস ছিল কলেরা এবং ম্যালেরিয়ার মতো রোগগুলো হয় ‘মিয়াজমা’র কারণে। বাতাসে ভাসতে থাকা মিয়াজমা কণা উৎপন্ন হয় আমাদের আশপাশের পচে যাওয়া জৈব পদার্থের উৎকট গন্ধ থেকে। ফলে জ্বরের জীবাণু বাতাসে ভর করে স্বাধীনভাবে ঘোরাফেরা করতে পারে। মানুষ ভাবত, ম্যালেরিয়া হলো মন্দ বাতাসের ফল। ক্ষুদ্র কীট মশা যে এই রোগের বাহক তা ঘুণাক্ষরেও কেউ জানত না।

যুদ্ধের ফলাফলে মশার ভূমিকা

উইনেগার্ড বিভিন্ন যুদ্ধ নিয়েও বেশ আগ্রহী ছিলেন। তিনি যুক্তি দেন, যুদ্ধের ইতিহাসে অসংখ্য সৈনিকের প্রাণ গিয়েছে ম্যালেরিয়া কিংবা মশাবাহিত রোগের কারণে। এমনকি অনেকক্ষেত্রে যুদ্ধের চেয়ে বরং মশাবাহিত রোগ জয়-পরাজয় নির্ধারণ করে দিয়েছে। দেখা গেছে, ম্যালেরিয়ার মহামারী শুধু কোনো অঞ্চলের জন্য অভিশাপই নয়, বরং বিভিন্ন সময় এটি ওই অঞ্চলগুলোর রক্ষাকবচ হিসেবেও কাজ করেছে। কারণ তাদের মারতে এসে ম্যালেরিয়া মহামারীতে মরে সাফ হয়ে গেছে ভিনদেশি শত্রুরা।

পানামায় স্কটিশ উপনিবেশ স্থাপনের আগে পঞ্চদশ শতকে সেখানে উপনিবেশ স্থাপন করতে চেয়েছিল রোমানরা। তাদেরও খুব করুণ পরিণতি হয়েছিল। ম্যালেরিয়ার আক্রমণে প্রায় ৮০ হাজার রোমান সৈন্যের অর্ধেকই প্রাণ হারানোর পর বাকিরা বাড়ির পথ ধরেছিল।

জানা যায়, খ্রিস্টপূর্ব ২১৮ থেকে ২০১ অব্দের মধ্যে ইতালি জয় করতে গিয়ে আফ্রিকান সেনাপতি হানিবলের কার্থেজিয়ান সেনাবাহিনীও মহামারীর কবলে পড়ে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। মোঙ্গল সেনাপতি চেঙ্গিস খান দক্ষিণ ইউরোপ থেকে আবারও উল্টোপথ ধরেছিলেন তার সেনাবাহিনী ম্যালেরিয়া মহামারীতে আক্রান্ত হওয়ায়। এমনকি পবিত্রভূমি রক্ষা করতে গিয়ে ইউরোপিয়ান ক্রুসেডাররাও পিছু হটেছিল। কারণ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে তাদের এক-তৃতীয়াংশ সৈন্য মারা গিয়েছিল। সালাদিন থেকে শুরু করে হিটলারের নাজি বাহিনীর যুদ্ধেও প্রভাব রেখেছে মশা। ব্রিটিশদের সঙ্গে যুদ্ধে ওয়ালচেরিনে ফরাসি বীর নেপোলিয়ন একটি খাল খনন করেছিলেন সামুদ্রিক বন্যায় ইংলিশদের প্রতিহত করার জন্য। কিন্তু তার আগেই ম্যালেরিয়া মহামারীতে ইংলিশদের চার হাজার সৈন্য মারা যায়। এ অবস্থায় নেপোলিয়ন ঘোষণা করেন, ‘আমরা ইংলিশদের প্রতিহত করেছি আর কিছু নয়, শুধু জ্বর দিয়ে। এবং এই জ্বর শিগগিরই তাদের বাকি সবাইকে গ্রাস করবে।’ তবে, বেশিরভাগ সময়ই যুদ্ধক্ষেত্রের দুই পক্ষই ম্যালেরিয়া মহামারীর কবলে পড়ত। কুখ্যাত এই জ্বর ইংলিশ প্রোটেস্ট্যান্টদের ক্যাথলিক আয়ারল্যান্ডে নিয়ে গিয়েছিল। ফলস্বরূপ সেখানে প্রায় শতাব্দীকাল ধরে বিবাদ চলেছে। আয়ারল্যান্ড দখল করা ইংলিশ অধিনায়ক ওলিভার কর্নওয়েল ১৬৫৮ সালে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারান।

অভিযাত্রীদের সঙ্গী ছিল মশা

ইতিহাসে ম্যালেরিয়ার সবচেয়ে নাটকীয় ভূমিকাটি ছিল যখন এটি এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে গিয়ে উপস্থিত হয়। ১৪৯২ সালে ইউরোপ থেকে প্রথমবারের মতো আমেরিকায় পা রাখেন কলম্বাস। কিন্তু তার জাহাজে করে নতুন মহাদেশে পৌঁছে যায় ম্যালেরিয়াবাহী মশা। এই মশা আমেরিকার ইতিহাস বদলে দিয়েছে অনেকাংশে। কারণ হিস্পানিওলাতে কলম্বাস পা রাখার মাত্র ২২ বছরের মধ্যেই স্থানীয় ‘তাইনো’ জনগোষ্ঠী ৮০ লাখ থেকে মাত্র ২৬ হাজারে নেমে এসেছিল। বসন্ত এবং ইনফ্লুয়েঞ্জার পাশাপাশি মশাবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রায় ৯৫ লাখ আমেরিকান আদিবাসী প্রাণ হারিয়েছিল বলে ধারণা করেন ঐতিহাসিক উইনেগার্ড। উপনিবেশকারীরা যত দ্রুত কোনো অঞ্চলকে গ্রাস করে রোগবালাই তারচেয়ে অনেকগুণ দ্রুততার সঙ্গে তা করে ফেলে।

১৫৩৬ সালে ফ্লোরিডা থেকে মেক্সিকো সিটিতে যাওয়ার পথে স্থানীয়দের সম্পর্কে একজন স্প্যানিশ নাবিকের এক দু®প্রাপ্য বিবরণীতে বলা হয়, ‘মশার কামড়ে তারা এতটাই বিপর্যস্ত যে, তাদের গায়ে চর্মরোগের মতো অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এই ভূমিটি দারুণ উর্বর এবং সুন্দর। প্রাণবন্ত ঝরনা আর নদীর ছড়াছড়ি। কিন্তু একের পর এক পুড়ে যাওয়া গ্রাম এবং সেখানকার রুগ্ণ আর অসুস্থ মানুষ দেখে আমরা খুব ব্যথিত।’ সপ্তদশ শতকে এই পরিস্থিতি আরও খারাপ হয় বলে এক ফরাসি অভিযাত্রীর বিবরণ থেকে জানা যায়। আটলান্টিক পাড়ি দেওয়া ক্রীতদাস ব্যবসায়ও বড় ভূমিকা রেখেছিল মহামারী মৃত্যু। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে ক্রীতদাসদের মূল্য নির্ধারণে ভূমিকা রাখত এটি।

৫২০০ কোটি মানুষের মৃত্যু!

উইনেগার্ডের ধারণামতে, অন্য যে কোনো কারণের চেয়ে মশার জন্যই পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তিনি মশাবাহিত রোগে এই পর্যন্ত কত সংখ্যক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে তারও একটি পরিসংখ্যান দেন। এই পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সৃষ্টির শুরু থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৫ হাজার ২০০ কোটি মানুষ মরেছে শুধুমাত্র মশার কারণে। এই সংখ্যাটি পৃথিবীতে এই পর্যন্ত যত মানুষ বসবাস করেছে তার প্রায় অর্ধেক। মশাকে তাই তিনি ‘পৃথিবীর ধ্বংসকারী’ এবং ‘ঐতিহাসিক পরিবর্তনের মুখপাত্র’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। মশার সঙ্গে লড়াই করেই এখনো বেঁচে আছে মানব প্রজাতি। বর্তমান কালে শুধুমাত্র আফ্রিকাতেই প্রতি বছর প্রায় আট লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটে মশাবাহিত রোগের কারণে। আজকের দিনে শুধু ম্যালেরিয়া নয়, মশা থেকে আরও ভয়ঙ্কর সব রোগের জন্ম হচ্ছে। এসব রোগের মধ্যে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, জিকা অন্যতম। ধারণা করা হয়, মশার হাত ধরে ডেঙ্গুজ্বর হাজার বছর আগেই পৃথিবীতে এসেছিল। তবে, জিকা এবং চিকুনগুনিয়া সর্বপ্রথম চিহ্নিত করা হয় ১৯৫২ সালে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আরও ধ্বংসাত্মক রূপে হাজির হচ্ছে ক্ষুদ্র মশা। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে আগামী ৫০ বছরের মধ্যে অন্তত ১০০ কোটি মানুষ মশার জন্য মৃত্যুঝুঁকিতে পড়বে।

আধুনিক গণতন্ত্রের নেপথ্যে মশা!

উইনেগার্ডের মতে, ঐতিহাসিক ম্যাগনাকার্টা চুক্তির নেপথ্যেও প্রচ্ছন্নভাবে ছিল মশা। এই চুক্তির মাধ্যমেই আধুনিক গণতন্ত্রের বিকাশ হয়েছ। উইনেগার্ড অঙ্ক কষে দেখান, ১১৪৮ সালে ম্যালেরিয়া সিজনে দামেস্কাস অধিগ্রহণে ব্যর্থ হয়েছিলেন রাজা সপ্তম লুইস। এই ব্যর্থতার জন্য তার সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটে রানী এলিনর অব অ্যাকুইটাইনের। লুইসের সঙ্গে বিচ্ছেদের পরই এলিনর বিয়ে করেন ইংল্যান্ডের রাজা সপ্তম হেনরিকে। হেনরির ঔরসে তার গর্ভে জন্ম নেয় রাজা জন। এই জন তার আমলে বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যারন তথা জমিদারদের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়েছিলেন। ১২১৪ সালে জন রাজা ফিলিপের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর পরিকল্পনা করেন। তার সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন ফিলিপের শত্রু সম্রাট অটো। তাদের মিলিত সৈন্যবাহিনী আনজু এবং পইতোতে আক্রমণ করে। কিন্তু চতুর ফিলিপের রণকৌশলের কাছে মার খায় জন এবং অটোর রণনীতি। এই যুদ্ধে হার রাজা জনের গলার কাঁটার মতো হয়ে ওঠে। বিবাদের ফলে দেশে ব্যারন সমাজের কাছে তিনি ততদিনে পরিত্যাজ্য হয়ে গেছেন। ফলে জনের পক্ষে কথা বলার মতো কেবল পোপই অবশিষ্ট ছিলেন।

১২১৫ সালের এপ্রিল মাসে ব্যারনদের একটি বিশাল সমাবেশ হয় যেখানে তারা সবাই ছিলেন সশস্ত্র। এই ঘটনায় রাজা জন অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। একে তো ফ্রান্সের রাজা ফিলিপ যেকোনো সময় আক্রমণ করতে পারে সেই চিন্তা, তার ওপর যদি গৃহযুদ্ধ ঘটে তাহলে তার পরিণাম যে ভালো হবে না সেটা জন ভালোভাবেই টের পাচ্ছিলেন। তিনি বাধ্য হয়ে ব্যারনদের বাজেয়াপ্ত করা জমিজমা ফিরিয়ে দিলেন। তাদের শান্ত করতে ওয়াদা করলেন যে পুরাতন নিয়মগুলো পরিবর্তন করে তিনি নতুন নিয়মকানুনের প্রবর্তন করবেন।

অবশেষে ১৫ জুন ১২১৫ সালে তিনি বিদ্রোহীদের সঙ্গে অনেক আলোচনা করে, আক্ষরিক অর্থে তাদের মতের প্রতিফলন ঘটিয়ে ঐতিহাসিক এক গঠনতন্ত্রের দলিলে সই করেন। তাই এই দিনটিকেই ম্যাগনাকার্টার প্রচলনের দিন হিসেবে ধরা হয়। এই দলিলে ব্যাপক পরিমাণ রাজনৈতিক সংস্কারের উল্লেখ করা হয়। করারোপের নতুন নিয়ম, অবৈধ বন্দিদের দ্রুত মুক্তি প্রদান, দ্রুত বিচারকার্য সম্পন্ন করা, যথাযথ কারণ ছাড়া কারও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত না করাসহ আরও অসংখ্য বৈপ্লবিক ধারার অবতারণা করা হয়। সর্বোপরি রাজার ক্ষমতা অনেকাংশে হ্রাস করা হয় এবং রাজ্য পরিচালনায় জনমতের প্রতিফলনের ব্যবস্থা করা হয়। ব্রিটিশদের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত একটি নাম হচ্ছে তাদের অধিকারের দলিল তথা ‘ম্যাগনাকার্টা’। এই ব্যবস্থাকেই আধুনিক গণতন্ত্রের প্রাথমিক ধাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বলা হয়ে থাকে, পৃথিবীতে কিং জনের জন্ম না হলে হয়তো ম্যাগনাকার্টা চুক্তির কোনো উপলক্ষই তৈরি হতো না। আর এই কিং জনের জন্মই হতো না যদি মশাবাহিত রোগ ম্যালেরিয়ার মহামারীতে দামেস্কাস বিজয় থেকে পিছু না হটে আসতেন তার সৎ বাবা সপ্তম লুইস!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Must Read

সবাইকে মাদকের বিরুদ্ধে সক্রিয় হতে হবে, প্রধানমন্ত্রী

দ্যা নিউজ বিডি অনলাইন ডেস্ক: মাদকের বিরুদ্ধে সবাইকে সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমরা যেমন উন্নত হচ্ছি, ঠিক তার পাশাপাশি মাদকের প্রভাবও...

শিবচরে নিয়ন্ত্রন হারিয়ে বাস খাদে, নিহত ১৭

দ্যা নিউজ বিডি অনলাইন ডেস্ক: পদ্মা সেতুর এক্সপ্রেসওয়ের মাদারীপুর জেলার শিবচরের কুতুবপুর এলাকায় ঢাকাগামী ইমাদ পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাস খাদে পড়ে ১৭ জন যাত্রীর...

খুবই অস্বাস্থ্যকর’ বায়ু নিয়ে আজও দূষণের শীর্ষে ঢাকা

দ্যা নিউজ বিডি অনলাইন ডেস্ক: বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকার র্শীষে অবস্থান করছে রাজধানী ঢাকা। আবহাওয়ার পরিবর্তনসহ মানবসৃষ্ট নানা কারণে দিন দিন যেন ঢাকায় নির্মল...

ইমরান খানকে গ্রেপ্তারে, লাহোরে তীব্র উত্তেজনা, সংঘর্ষ

দ্যা নিউজ বিডি,আন্তর্জাতিক ডেস্ক: পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে পুলিশ তোষাখানা মামলায় গ্রেফতার করতে চাচ্ছে। তার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকলেও এই একটি...

আজ পবিত্র শবে বরাত

দ্যা নিউজ বিডি অনলাইন ডেস্ক: আজ পবিত্র শবে বরাত । যথাযোগ্য ধর্মীয় মর্যাদায় ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা রাতে মহান আল্লাহর রহমত কামনায় নফল ইবাদত-বন্দেগীর মধ্য দিয়ে...