অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আমাদের প্রায় সবকিছু আছে। কেবল নেই দুটো জিনিস এর মধ্যে একটি হচ্ছে শেয়ারবাজার এবং অন্যটি হচ্ছে ব্যাংকিং খাত। এক্ষেত্রে একটির সঙ্গে আরেকটির সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। শেয়ারবাজার ঠিকমতো কাজ করলে ব্যাংকঋণের প্রয়োজন কমে। আর শেয়ারবাজার না থাকলে একসময় ভরসা হয় ব্যাংক। এখন দেখা যাচ্ছে দুটোর একটিও নেই। কিন্তু আমাদের আমদানি-রফতানি ব্যবসা ঠিক আছে। ‘রেমিট্যান্স’ ঠিক আছে। জাতীয় উৎপাদনের (জিডিপি) হার বেশ উঁচুতে। রিজার্ভের পরিমাণ ভালো। চালে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। মত্স্য চাষে বাংলাদেশ ভালো করছে। অর্থাৎ অর্থনীতির অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ বেশ ভালো করছে। একসময়ের সমালোচকরাও আমাদের প্রশংসা করেন এখন। কিন্তু যে জায়গায় আমরা আটকা পড়ে গেছি, সেটি হচ্ছে শেয়ারবাজার ও ব্যাংকিং ব্যবসা। এ দুটো ব্যবসায় এখন সমস্যা আর সমস্যা। শেয়ারবাজার যেহেতু হচ্ছে না, তাই সবার নজর ব্যাংকের দিকে। এখানেই পুঁজি পাওয়া যায়। পুঁজি মানে ‘ক্যাপিটাল’। বহু চেষ্টা হয়েছে শেয়ারবাজারকে উজ্জীবিত করার জন্য। কিন্তু তা উজ্জীবিত হয়নি। বরং নিকট অতীতে দু-দুবার শেয়ারবাজার থেকে একশ্রেণীর ব্যবসায়ী হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করেছেন। দুবারই শেয়ারের দাম বাড়িয়ে কোম্পানির মালিকরা তাদের পুরো শেয়ার বিক্রি করে ফায়দা লুটেছেন, হয়েছেন ‘দিগম্বর’ মালিক। অনেক কোম্পানিতেই এখনো অনেক মালিকের কোনো শেয়ার নেই। বাজারে ভালো শেয়ার নেই। অনেক সময় লিকুইডিটির অভাব, মধ্যবিত্তের আস্থাহীনতা ইত্যাদি কারণে শেয়ারবাজার দাঁড়াচ্ছে না, নাকি একশ্রেণীর ব্যবসায়ী চায় না শেয়ারবাজার ঘুরে দাঁড়াক? শেয়ারবাজার থেকে মূলধন সংগ্রহ করলে মালিকরা অনেক জবাবদিহিতার সম্মুখীন হন। বিপরীতে ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে সেই অর্থে কোনো জবাবদিহিতা নেই। এ রকম একটা অবস্থা সৃষ্টিতে সরকারের নীতি কাজ করছে বলে আমার ধারণা। দেশে মূলধনের অভাব, স্বাধীন বাংলাদেশে মূলধন কার, কতজনের ছিল? ‘মর্টগেজ’ দেয়ার মতো সম্পত্তি কতজনের ছিল? ১৯৮২-৮৩ সালের দিকেও ৮-১০ কোটি টাকা মূলধন দিয়ে ব্যাংক করার মতো লোক ছিল না। এটা বাস্তবতা। এ সংকট থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সরকার যে নীতি গ্রহণ করে, তাকে বলা যায় ‘ব্যাংক ফিন্যান্স লেড গ্রোথ’। অর্থাৎ পুঁজি আসবে ব্যাংক থেকে। বাণিজ্যিক ব্যাংকের সুবিধাও একটি হয়। তাদের মেয়াদি আমানত (টাইম ডিপোজিট) ও তলবি আমানতের (ডিমান্ড ডিপোজিট) মধ্যে মেয়াদি আমানতের পরিমাণ বেশ বাড়তে থাকে। এতে ব্যাংকগুলো শিল্পে অর্থ জোগান দিতে সাহসী হয়। ব্যাংকের টাকায় ব্যবসা—এ নীতি শুধু আমাদের নয়। চীন ও ভারতও এ নীতি অনুসরণ করে এখন বেশ বিপদে। ভারতের অনেক বড় বড় ব্যবসায়ী ব্যাংকের টাকা মেরে দেশ ত্যাগ করেছেন। চীনের ব্যবসায়ীরা টাকা ফেরত না দিলেও সরকারি ব্যাংক আরো টাকা দিতে কার্পণ্য করে না। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে ঘটনাটা ঘটছে একটু ভিন্নভাবে। ভারতে পুঁজির অভাব আমাদের মতো ছিল না। চীনের উন্নয়নে হংকংবাসী চীনারা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার প্রথমদিকে বিনিয়োগ করেছে কিন্তু আমাদের সমস্যা ছিল অনেক। সদ্য স্বাধীন দেশ। ব্যবসার দিগন্ত খুলে গেছে। আমদানি-রফতানি ব্যবসা, গার্মেন্ট ব্যবসা হাতছানি দিচ্ছে। শিল্প করার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। অথচ মূলধন নেই। এতে সরকারের উদার নীতি কাজে লাগে। ব্যাংকাররা ওই নীতির পুরো সুযোগ নেন। কীভাবে? একজন শিল্প করবেন। তার ‘ইকুইটি’ দরকার, কীভাবে তা জোগাড় হবে? যেনতেন প্রকারে এক খণ্ড জমি জোগাড় করে শিল্পোদ্যোক্তা ব্যাংকে এলেন। ওই জমিই উদ্যোক্তার ইকুইটি। তার বিপরীতে ব্যাংক উদারভাবে ঋণ দিল। পণ্যের জন্য এলসি খুলল। ১ টাকার পণ্যে ২ টাকার এলসি হলো। এতে ১ টাকা উদ্যোক্তার হাতে এসে গেল। জমির মালিকানা ঠিক আছে কিনা, সে সম্পর্কে বিশেষ প্রশ্ন করলে উদ্যোক্তা ঋণ পান না। ১ টাকার পণ্যে ২ টাকার এলসি না করলে উদ্যোক্তার ক্যাপিটাল ফরমেশন হয় না। এখন অস্বীকার করা হতে পারে, বাস্তবে এভাবেই শুরু শিল্পায়নের কাজ। ছোট ছোট কোম্পানি। ১ লাখ, ২ লাখ টাকা অনুমোদিত মূলধন। পারিবারিক কোম্পানি। উদ্যোক্তা, তার ছেলেমেয়ে, স্ত্রী, শ্যালকরা পরিচালক। কারো কোনো অভিজ্ঞতা নেই। অথচ দেখা গেল তারা ৫০ কোটি, ৬০ কোটি, ১০০ কোটি টাকার পণ্য আমদানির জন্য এলসি (ঋণপত্র) খুলছেন। ব্যাংক তাকে জিজ্ঞেস করছে না, আপনার পুঁজি এত কম কেন? অথবা আপনার পুঁজি বৃদ্ধি করুন, নতুবা এত বিশাল পরিমাণের পণ্য আমদানির এলসি করা যাবে না। প্রভাবশালী উদ্যোক্তা এ ঋণ কোথা থেকে নিল এখানেই শেষ নয়। আমদানির পর পণ্য ছোটানোর ক্ষমতা নেই, টাকা নেই। কী করণীয়? ব্যাংকের কাছে তিনি এলেন। বললেন, আমাকে ‘টিআর’ দিন। টিআর মানে ‘ট্রাস্ট রিসিট’। বিশ্বাস করে ঋণ দিন। বন্দর থেকে পণ্য ছুটিয়ে তা বিক্রি করে অচিরেই ঋণের টাকা শোধ করে দেয়া হবে—এই হবে উদ্যোক্তার অঙ্গীকার। প্রভাব খাটিয়ে এ সুবিধাও নিয়ে নিলেন। এবার কী করণীয়? পণ্য বিক্রি হলো কিন্তু ব্যাংকে টাকা এল না। টাকা ‘ডাইভার্ট’ করা হলো। তাহলে? এবার ব্যাংক বাধ্য হয়ে উদ্যোক্তার পুরো ঋণকে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ করে দিল। ধীরে ধীরে উদ্যোক্তা বড় হলেন। তিনি পরে এ ঋণকে প্রথমে বারবার ‘পুনঃতফসিল’ করালেন, তারপর ঋণ ‘পুনর্গঠনের’ সুবিধা নিলেন। সুদের হার কম। ডাউন পেমেন্ট কম। গ্রেস পিরিয়ড আছে। পরিশোধের সময়সীমা বেশি। উদ্যোক্তার অবস্থা রমরমা। পুঁজি গঠনের এর চেয়ে উত্তম ব্যবস্থা আর কী? ছোট কোম্পানি, বড় বড় ঋণপত্র খোলা, টিআরের অধীনে পণ্য বন্দর থেকে খালাস করে বিক্রি করা, ওই টাকা ফেরত না দিয়ে একে মেয়াদি ঋণে রূপান্তর করা, ঋণ পুনঃতফসিল করা এবং ঋণ পুনঃকাঠামোকরণ—এমন সুযোগ কে না গ্রহণ করে?
‘মর্টগেজ’ দেয়ার মতো সম্পত্তি নেই, বাড়ি নেই, ঘর নেই। তাহলে করণীয় কী? একটা ব্যাংক পণ্য তৈরি করা হলো। এর নাম পারসোনাল গ্যারান্টি ও করপোরেট গ্যারান্টি। এসবই সিকিউরিটি। কোম্পানিটি প্রাইভেট কোম্পানি। পরিচয় ‘গ্রুপ’ হিসেবে। এখন সবাই তা করেন। ছোট ছোট কোম্পানি তৈরি করে পরিচয় দেয়া হয় ‘গ্রুপ’। বলা বাহুল্য, এসব গ্রুপের কোনো আইনি ভিত্তি নেই। এখানে কোনো হোল্ডিং কোম্পানিও নেই, সাবসিডিয়ারি কোম্পানিও নেই। নিতান্তই নিজেদের সম্পর্কে উঁচু ধারণা দেয়ার জন্য এসব করা হচ্ছে। ব্যাংকও এসব গ্রুপের মালিকদের পারসোনাল গ্যারান্টি ও করপোরেট গ্যারান্টি অবলীলায় গ্রহণ করছে। বলা বাহুল্য, এ ধরনের সিকিউরিটির পেছনে কোনো আর্থিক শক্তি নেই। এসব গ্যারান্টির বাজারমূল্য কিছুই নেই। তবু ব্যাংকাররা এ দুটো পণ্যের যথেচ্ছ ব্যবহার করে ব্যাংকিং খাতকে ‘ফতুর’ করার ব্যবস্থা করছে। বস্তুত, এ দুটো গ্যারান্টি এত বেশি ব্যবহার হচ্ছে যে এর ফলে ব্যাংকের বিপুল পরিমাণ ঋণ প্রকৃতপক্ষে ‘সিকিউরিটিহীন’ হয়ে পড়েছে। আমাদের ‘সোনার বাংলাদেশ ব্যাংক’ এসব বসে বসে দেখছে। বলছে তারা তদারক করছে, খবরদারি করছে। তার চেয়ে প্রতারণা আর কী হতে পারে?
আরেক ধরনের পথ আবিষ্কৃত হয়েছে। বিদেশ থেকে ঋণ জোগাড় করা হয়েছে। কিন্তু শর্ত হচ্ছে দেশীয় ব্যাংকের গ্যারান্টি লাগবে। তাহলেই বলুন, কেমন বিদেশী ঋণ! ঋণ আনা হলো। তারপর উদ্যোক্তা আর ব্যাংকের টাকা দিতে পারেন না। যেহেতু ব্যাংক বিদেশী ব্যাংককে গ্যারান্টি দিয়েছে, অতএব কোনো বিকল্প নেই। উদ্যোক্তা টাকা না দিতে পারলে ব্যাংককেই সেই টাকা পরিশোধ করতে হবে এবং দেশীয় মুদ্রায় সেই ঋণ সৃষ্টি করা হবে উদ্যোক্তার নামে। এ ঘটনা ব্যাংকিং খাতে বহু। আরেকটি ঘটনা ব্যাংকিং খাতকে বড় বড় সমস্যার মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। গত ২০-৩০ বছরে দেশে অনেক বড় বড় ব্যবসায়ী হাউজ তৈরি হয়েছে। তারা এত বড় হয়েছে যে ব্যাংকাররা তাদের পেছনে পেছনে ঘোরেন। দেশে অনেক ব্যাংক। ‘এমডি’ সাহেবদের টার্গেট দেয়া হয়। তারা তা পরিপূরণে বাজারে নামেন। ১ টাকা, ২ টাকার ব্যবসায়ীর পেছনে ঘুরে তাদের সময় নষ্ট। তারা বড় বড় পার্টির পেছনে ঘোরেন। এক ব্যাংকের পার্টি আরেক ব্যাংকে ভাগিয়ে আনেন। ১ টাকা ঋণ থাকলে আরেক ব্যাংক দেয় ২ টাকা। আরেক ব্যাংক দেয় ৩ টাকা। ব্যবসা ও ব্যবসায়ীর মূল্যায়ন না করেই তারা ঋণের পর ঋণ দিতে থাকে। এ কারণে দেখা যাচ্ছে দেশের অনেক শিল্প ‘ওভার ক্যাপাসিটি’ সমস্যায় ভুগছে। চিনি, ইস্পাত, বস্ত্র, আসবাব এমনকি তৈরি পোশাক খাতেও ওভার ক্যাপাসিটি তৈরি হয়েছে। অনেক অবিবেচক ব্যাংকারের ব্যবসাবহির্ভূত বিবেচনায় দেয়া ঋণের ফলেই এটা ঘটছে। এ সম্পর্কে দৈনিক বণিক বার্তায় প্রায় সপ্তাহেই প্রতিবেদন ছাপা হয়। আমি এখানে এসবের উল্লেখ করব না। তবে বলতেই হবে যে এ ওভার ক্যাপাসিটি এখন ব্যাংকের বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যত পরিমাণ উৎপাদন দেখিয়ে ঋণ নেয়া হয়েছে, তা না হলে আয়ও সেই পরিমাণে কমবে। আয় কমলে ব্যাংকের টাকাও ফেরত আসবে না। এ সমস্যায় এখন অনেক বড় বড় হাউজ পড়েছে। এখানে সমস্যা হচ্ছে ওভার ক্যাপাসিটিতে ফিন্যান্স করতে গিয়ে প্রচুর পরিমাণ টাকা বড় বড় পার্টির কাছে আজ বন্দি হয়ে পড়েছে। ২, ৪, ৫, ৭ হাজার কোটি টাকার কাস্টমার এখন অনেক। অথচ তাদের অনেকেরই ‘ক্যাশ’ জেনারেট করার ক্ষমতা নেই। তাদের পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ খুবই কম।
এভাবে ঘটনার পর ঘটনার বর্ণনা দেয়া যায়, যেসব কারণে আজ ব্যাংকিং খাত ‘গাড্ডায়’ পড়েছে। আমি শক্তভাবে বিশ্বাস করি, ‘ব্যাংক ফিন্যান্স লেড গ্রোথ’ মডেলই আজকের ব্যাংকিং সংকটের কারণ। প্রশ্ন উঠতে পারে, এছাড়া আমাদের বিকল্প কী ছিল? উদ্যোক্তা আছে, পুঁজি নেই; পুঁজি আছে তো মর্টগেজ দেয়ার মতো সহায়-সম্পদ নেই; ‘লিয়েন’ দেয়ার মতো ব্যাংক আমানত ইত্যাদি নেই। এ অবস্থায় ব্যাংকগুলোর করণীয় কী ছিল? এ আলোচনা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে এখন করা দরকার। ব্যাংকের টাকা দিয়েই কি আজকের শিল্পায়ন হয়নি? ব্যবসা-বাণিজ্যের অভূতপূর্ব উন্নতি কীভাবে সম্ভব হলো, এখানে কি ব্যাংকের টাকা নেই? সবচেয়ে বড় কথা, ৪৮ বছর ব্যাংকিং করার পর ব্যাংকের ১০০ টাকার মধ্যে কত টাকার হিসাব নেই, তা কি বের করা যায় না? বের করে কৃষকদের যেমন কোমরে দড়ি বেঁধে আদালতে নেয়া হয়, তার মতো ব্যবস্থা করা যায় না