জরুরি বিভাগের টিকিট কাউন্টারে ভিড়। প্রতি দশজনের ৫ জনই এসেছেন জ্বর নিয়ে। আসছেন একের পর এক। টিকিট নিয়ে আবাসিক চিকিৎসকের (আরপি) কাছে গেলে রোগীকে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে মেডিসিন বিভাগে। সেখানে চিকিৎসকরা দেখার পর প্রায় সবাইকেই রক্তের পরীক্ষা (সিবিসি ও এনএসওয়ান) দিচ্ছেন। নির্ধারিত স্থানে গিয়ে পরীক্ষার জন্য রক্তের নমুনা দিচ্ছেন রোগী।এ চিত্র শুক্রবার সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের। এদিন প্রায় একই চিত্র দেখা গেছে রাজধানীর মুগদা জেনারেল হাসপাতালেও। এ হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত দুইজন মারা গেলে স্বজনের কান্নায় ভারি হয়ে ওঠে পরিবেশ। আতঙ্ক ছড়ায় ডেঙ্গু রোগী, স্বজন ও জ্বর নিয়ে আসা ব্যক্তিদের মধ্যে। ঢামেক হাসপাতাল : সকাল পৌনে ১০টায় দেখা যায়, জরুরি বিভাগের টিকিট কাউন্টারে দীর্ঘ সারি। এর অর্ধেকেরই বেশি এসেছেন জ্বর নিয়ে। সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে দেখা যায়, জ্বর নিয়ে প্রায় প্রতি মিনিটে একজন করে রোগী আসছেন।
নতুন ভবনের দ্বিতীয় তলায় খোলা হয়েছে ডেঙ্গু পরীক্ষার সেল। সেখানে ডেঙ্গু ভাইরাস শনাক্তের পরীক্ষা এনএনওয়ানের জন্য নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এছাড়া আইজিজি/আইজিএম টেস্টের জন্য নমুনা সংগ্রহ করা হয় একই ভবনের নবম তলায় হেমাটোলজি বিভাগের ল্যাবরেটরিসহ তিন স্থানে।
নবম তলায় বেলা ১১টা ৫০ মিনিট থেকে ১২টা পর্যন্ত ১০ মিনিট পর্যন্ত দাঁড়িয়ে দেখা গেছে, এ সময়ে ১১ জন এসেছেন রক্তের সিবিসি ও এনএসওয়ান পরীক্ষার জন্য। সেখানকার স্বাস্থ্য সহকারী সিবিসির জন্য রক্ত সংগ্রহ করে যথাস্থানে তা পাঠিয়ে দিচ্ছেন। স্বাস্থ্য সহকারী সুজন দাস বলেন, আগে যেখানে দৈনিক এক বেলা গড়ে দেড়শ’ রোগীর সিবিসি করানোর নমুনা সংগ্রহ করা হতো, সেখানে এখন ৩শ’ থেকে সাড়ে ৩শ’ নমুনা নিতে হচ্ছে। কোনো কোনো দিন চারশ’ পর্যন্ত নমুনা নিতে হচ্ছে।
সেখানে তখন স্ত্রী তাহমিনা বেগমের (২৪) রক্তের নমুনা দিতে এসেছিলেন নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা মিথুন। তিনি বলেন, আমার স্ত্রীর অন্য সমস্যা আছে। কিন্তু কয়েকদিন ধরে তার জ্বর। বর্তমানে ডেঙ্গুর প্রকোপ চলছে। আসলে সমস্যাটা কী সেটা নিশ্চিত হতেই ডেঙ্গু পরীক্ষা করাচ্ছি। সমস্যা বলার পর চিকিৎসক এই পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দিলেন।
এ সময় মহাখালী থেকে আসা মুন্না (১৮) নামে একজনকে নিয়ে আসেন তার বড় ভাই রানা। মুন্না বলেন, ঈদের আগের দিন থেকে তিনি জ্বরে আক্রান্ত। এটা নিয়ে গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলেন। কিন্তু জ্বর যাচ্ছে না। তাই দ্রুত ঢাকা এসে হাসপাতালে এসেছেন। ডাক্তার ডেঙ্গু পরীক্ষা দিয়েছেন।
ডেঙ্গুর মূল পরীক্ষা করা হয় হাসপাতালের দ্বিতীয় তলায় প্রশাসনিক ব্লকে স্থাপিত ডেঙ্গু সেলে। সেখানে একপাশে রক্তের নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে, আরেক পাশে পরীক্ষার রিপোর্ট সরবরাহ করা হয়। ডেঙ্গুর প্রকোপ শুরুর পর হাসপাতালে ২৪ ঘণ্টায় তিন শিফটে রক্তের নমুনা সংগ্রহের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সকাল ৮টায় শুরু করে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত প্রথম, দুপুর আড়াই থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত দ্বিতীয় এবং সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১টা পর্যন্ত তৃতীয় শিফট। কিন্তু শুক্রবার সকাল ৮টার পরিবর্তে ১০টায়ও নমুনা সংগ্রহের কাজ শুরু হয়নি। এর মধ্যে অসংখ্য রোগীর ভিড় জমে যায়। রোগীরা ক্ষোভ প্রকাশ করতে শুরু করেন। খবর পেয়ে কর্তৃপক্ষ সোয়া ১০টায় কয়েকজন নার্সকে নিযুক্ত করে নমুনা সংগ্রহের জন্য।
দুপুর পৌনে ১টায় এ প্রতিবেদক অবস্থানকালে ওই নার্সদের নমুনা সংগ্রহ করতে দেখা গেছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে হাসপাতালের কেউই আনুষ্ঠানিকভাবে কথা বলতে রাজি হননি। দায়িত্বরত এক নার্স বলেন, সকাল ১০টা থেকে রক্তের নমুনা নিচ্ছি। ২ ঘণ্টায় ১২০ জনের নমুনা সংগ্রহ করেছি।ওই কক্ষের পশ্চিম পাশ থেকে সরবরাহ করা হয় রক্ত পরীক্ষার প্রতিবেদন। প্রতিবেদন সরবরাহে নিয়োজিত কর্মী মো. ইমরান জানান, হাসপাতালে জনবল সংকট আছে। এ কারণে ডেঙ্গু প্রকোপের পর তাকেসহ কয়েকজনকে স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে বিশেষ দায়িত্ব পালনের জন্য আনা হয়েছে। তিনি বলেন, মানুষের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে। এ কারণে সামান্য জ্বর হলেও অনেকে ছুটে আসছেন।
কিন্তু সবাই ডেঙ্গু আক্রান্ত নয়। বৃহস্পতিবার ৭৯৫ জনের রক্তের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। তাদের মধ্যে ৪২ জনের ডেঙ্গু ধরা পড়েছে। তিনি উল্লেখ করেন, দায়িত্ব গ্রহণের পর এখন পর্যন্ত যত ডেঙ্গু রোগী চিহ্নিত হয়েছে তার অর্ধেকই লালবাগসহ পুরান ঢাকার।
ওই ডেস্কের সামনে অবস্থানকালে বেশ কয়েকজন রোগীর স্বজন আসেন রিপোর্ট সংগ্রহের জন্য। কিন্তু রিপোর্ট হয়নি বলে তাদের ফিরিয়ে দিচ্ছিলেন ইমরান। তিনি বলেন, রক্ত পরীক্ষার মূল উপাদানটি নেই রাত থেকে। তাই বৃহস্পতিবার রাতে যত রোগীর নমুনা নেয়া হয়েছে কারও রিপোর্ট তৈরি হয়নি। তবে বিকাল ৩টার পর রিপোর্ট দেয়া হবে।
এ সময় হাসিনা বেগম নামে যাত্রাবাড়ী থেকে আসা এক নারী বলেন, তার মেয়ের রক্তের পরীক্ষা করানোর নমুনা বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জমা দিয়েছেন। কিন্তু এখনও সেই রিপোর্ট দেয়া হয়নি।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় ১১৮ জন নতুন রোগী ভর্তি হয়েছেন ডেঙ্গু নিয়ে। এ নিয়ে ওই হাসপাতালে বর্তমানে ৬৮৩ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন আছেন। হাসপাতালের নতুন ভবনের চারটি ফ্লোর এবং বার্ন ইউনিটের নতুন ভবনের নিচতলায় তাদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
মুগদা জেনারেল হাসপাতাল : ৮, ৯ ও ১০ তলায় বেড, ফ্লোর, বারান্দা ও ফ্লোরের টয়লেটের আশপাশ থেকে শুরু করে লিফটের সামনে- সবখানেই ডেঙ্গু রোগী। তাদের চোখেমুখে যন্ত্রণার ছাপ। বিশেষ করে শিশুদের অবস্থা নাজুক। অতিরিক্ত এসব রোগীর চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক ও নার্সরা। যেখানেই একটু জায়গা পাওয়া গেছে, সেখানেই বিছানা পেতে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
হাসপাতালের নার্স ইন সুপারভাইজার তোহুরুন্নেছা যুগান্তরকে বলেন, প্রতিদিনই রোগী ভর্তি হচ্ছে। ১৫ আগস্ট পর্যন্ত ৩৬৫ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি ছিল। এর মধ্যে ১০৬ জনকে বাড়ি যেতে দেয়া হয়েছে। আবার নতুন করে ১০৯ জন ভর্তি হয়েছে। রোগীদের সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তাই আমরা নতুন করে ১৫০ জন নার্স আনার জন্য ডিমান্ড দিয়েছি।
কর্তৃপক্ষ জানায়, শুক্রবার নতুন করে ৪৬ জন ভর্তি হয়ে সর্বমোট ৩৮৪ জন ডেঙ্গুজ্বর নিয়ে ভর্তি আছেন। এর মধ্যে ৭২ জন শিশু। সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে কহিনুর বেগম (৩২) নামে একজন আইসিইউতে মারা গেছেন। এছাড়া দক্ষিণ খিলগাঁও থেকে আসা মো. আবদুল মান্নান (৬০) বেলা ২টা নাগাদ মারা যান। আবদুল মান্নানের মৃত্যুর পর সেখানে হৃদয়বিদারক অবস্থা তৈরি হয়। মেয়ে সুমি কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। ছেলে সুমন মাহমুদ কাঁদতে থাকেন বাবার লাশ জড়িয়ে ধরে। তা দেখে সেখানে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও স্বজনদের আতঙ্ক বেড়ে যায়।
মতিঝিল থেকে আসা গিতা রানী (৩৫) যুগান্তরকে বলেন, ঈদের আগ থেকে এই হাসপাতালে ভর্তি আছি। চিকিৎসা চলছে। আগের তুলনায় এখন একটু ভালো। নয়াপল্টন থেকে আসা মো. ইব্রাহিম যুগান্তরকে বলেন, আমার নিজের ডেঙ্গু হয়েছিল। চিকিৎসা নিয়েছি। এখন ভালো। তবে আমার ভাগ্নি তানিয়ার (৮) ডেঙ্গু ধরা পড়েছে। তার চিকিৎসা করাচ্ছি। ছোট মানুষ কিছুক্ষণ পরপর কষ্টে যন্ত্রণায় কাঁদছে। বলতেও পারছে না কেমন লাগছে। তা দেখে কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে।এখানে ডেঙ্গুর চিকিৎসা চললেও ভবনের নিচেই পানি জমে থাকতে দেখা গেছে এদিন। হাসপাতালের প্রতিটি ফ্লোরের একাধিক এয়ারকন্ডিশনার থেকে এই স্বচ্ছ পানি বের হয়ে নিচে পড়ছে। এছাড়া সপ্তম তলার বারান্দায় ফেলে রাখা গাছের টবে স্বচ্ছ পানি জমে থাকতে দেখা গেছে। চতুর্থ তলায় হাসপাতালের পরিচালক যেখানে বসেন সেই ফ্লোরের বারান্দায় বৃষ্টির পানি জমে থাকতে দেখা গেছে।এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, আমরাও লক্ষ্য করেছি হাসপাতালের এয়ারকন্ডিশনার থেকে পানি পড়ে নিচে জমে আছে। যার কারণে এগুলো পরিষ্কার করতে ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা সচল করতে কাজ করাচ্ছি। আজই আমরা লোক আনিয়ে কাজ করাচ্ছি। আশা করি বিকাল নাগাদ এমন পরিস্থিতি আর থাকবে না।