দ্যা নিউজ বিডি, নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজধানীর পান্থপথের বাসিন্দা আব্দুল্লাহ আল মামুন (৩৭)। জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হন। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় চিকিৎসার জন্য ভর্তি হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে। সেখানে প্রায় ১৭ দিন চিকিৎসা নিয়ে গত ১ আগস্ট বাসায় ফেরেন তিনি। করোনামুক্ত হলেও এখনো তার ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আসছে না। ইনসুলিন ব্যবহার করেও ডায়াবেটিসের মাত্রা নামছে না ১৭-এর নিচে। বিষয়টি নিয়ে তিনি খুব চিন্তায় আছেন।মামুন বলেন, ‘করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত আমার ডায়াবেটিস ছিল না। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরই আমার ডায়াবেটিস ধরা পড়ে। এ ছাড়া সুস্থ হয়ে বাসায় ফেরার এক মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো অনেক দুর্বল লাগে। হাঁটতে বেশ সমস্যা হয়। পায়ে ঠিকমতো শক্তি পাই না।’
করোনা থেকে সুস্থ হওয়ার পর স্মৃতিভ্রমের মতো সমস্যা অনুভব করছেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা আহমেদ ফারুক। তিনি বলেন, ‘খুবই শারীরিক দুর্বলতা অনুভব করি। এবং হঠাৎ হঠাৎ স্মৃতি বিস্মৃতির সমস্যায় পড়ছি। সেটা হচ্ছে, ধরেন আমি কাউকে ফোন করব, যখন হয়ত আমি ফোন করতে যাই, তখন আমি কাকে ফোন করব, সেটা ভুলে যাই।’ এভাবেই করোনা ভাইরাস থেকে মুক্তি পাওয়া রোগীদের শরীরে দেখা দিচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি নানা সমস্যা। এমনকি মানসিকভাবেও তারা মুখোমুখি হচ্ছেন নানা সমস্যার। আক্রান্ত থেকে সুস্থ হওয়া অনেকেই জানিয়েছেন, তারা মেরুদণ্ডের ব্যথা, মাথাঘোরা, দুর্বলতা, স্মৃতিভ্রম, অস্থিরতার মতো সমস্যায় ভুগছেন। আবার অনেকের মধ্যে কিডনি, লিভার ও হৃদযন্ত্রের সমস্যা দেখা দিচ্ছে। অনেককেই বেগ পেতে হচ্ছে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে। এ অবস্থায় দীর্ঘ মেয়াদের নেতিবাচক প্রভাব কাটাতে বিভিন্ন হাসপাতালে করোনা-পরবর্তী ‘ফলোআপ’ চিকিৎসায় চালু হচ্ছে বিশেষ ক্লিনিক। করোনা-পরবর্তী সমস্যা চিহ্নিত করে চিকিৎসা প্রদানে ইতোমধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে কোভিড-১৯ পরবর্তী ফলোআপ ক্লিনিক চালু হয়েছে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, করোনা ভাইরাসে আক্রান্তরা একবার সুস্থ হয়ে উঠলেও দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হওয়াসহ শরীরে নানা ধরনের জটিলতা দেখা যাচ্ছে। সাধারণ কোভিড রোগীদের এক-তৃতীয়াংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, রোগ-পরবর্তী সময়ে তারা প্রচণ্ড দুর্বলতায় ভোগেন। এ ছাড়া কাজে অমনোযোগিতা, মানসিক বিক্ষিপ্ততা, মাথাব্যথা ও মাথা ঘোরা, হাত-পা জ্বালাপোড়া, ঘুম না হওয়া, বুক ধড়পড়, শারীরিক ক্লান্তি ইত্যাদি সমস্যাও দেখা যায়। অনেকের ক্ষেত্রে নিকট-অতীতের স্মৃতিভ্রম, নতুন কিছু শেখা বা করার ক্ষেত্রে ধীরগতি, দ্বিধা, একাকিত্ববোধ, মতিভ্রম প্রভৃতি হতে পারে। আর কোভিড হাসপাতালের বা আইসিইউর ভীতিকর স্মৃতিতে উদ্বেগে ভোগেন অনেকে। কেউ কেউ স্বজন হারানোর বেদনা বা অর্থনৈতিক চাপে বিষণ্নতায় আক্রান্ত হতে পারেন। অনেকের মধ্যে বিভিন্ন রকম মানসিক অবসাদ দেখা দিতে পারে। এ ছাড়া পুরুষদের ক্ষেত্রে সাময়িক বন্ধ্যাত্ব ও নারীদের হতে পারে গর্ভধারণজনিত জটিলতা।
এ প্রসঙ্গে হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালের চেয়ারম্যান ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী মানবকণ্ঠকে বলেন, ‘করোনা থেকে মুক্ত হওয়ার পরও রোগীরা মানসিক অবসাদ, শারীরিক ক্লান্তি, শরীরে ব্যথা, মাথা ঘোরা, বুক ধড়ফড়, প্রচণ্ড দুর্বলতা, ঘুম না হওয়া- এ জাতীয় রোগে ভোগে। একই সঙ্গে যাদের ব্লাড সুগার একেবারে সীমানারেখায় ছিল, তাদের মধ্যে ডায়াবেটিসের লক্ষণ দেখা দেয়, ব্লাড প্রেসার বেড়ে যায়। এটা হয় মূলত করোনা শরীরে প্রচণ্ড চাপ ফেলে, ফলে শরীরের প্রধান অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোর কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়। শরীরের দ্বিপক্ষীয় প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’ করোনা-পরবর্তী এসব রোগের প্রভাব কত দিন থাকে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘চার থেকে ছয় সপ্তাহ পর্যন্ত স্বাভাবিকভাবে এসব রোগের প্রভাব থাকে। আর যাদের ডায়াবেটিস এবং ব্লাড প্রেসার হয়, তাদের রোগটা দীর্ঘমেয়াদি হয়ে যায়।’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের প্রাক্তন চেয়ারম্যান ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ মানবকণ্ঠকে বলেন, ‘করোনা-পরবর্তী সময়ে অনেকের নানা রোগ দেখা দেয়। তবে এসব সাময়িক রোগ। কিছুদিন পর তা ভালো হয়ে যায়। তবে যাদের আগে কোনো রোগ থাকে, সেই রোগ আবার দেখা দিতে পারে। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এসব রোগ ভালো হয়ে যাওয়ার কথা। এর পরও যদি না কমে তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিত। অন্য কোনো কারণ আছে কি না দেখার জন্য।’
ঢাকার মুগদা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. টিটো মিয়া বলেন, ‘মানসিক অবসাদ থেকে শুরু করে স্মৃতিভ্রমের মতো জটিল নানা সমস্যা তৈরি হচ্ছে সুস্থ হওয়া মানুষের শরীরে। প্রথমে দেখা যায় তারা মানসিক অবসাদে ভুগছেন। রোগীরা অভিযোগ করে, আনডিউ টায়ার্ডনেস। তারা বলে, তাদের কিছু ভালো লাগছে না, কিছু করতে ইচ্ছা করছে না। এ রকম একটা অবস্থা থাকে।’ তিনি বলেন, ‘কারো কারো দেখা যায়, প্যানিক ভাবটা থাকে। হঠাৎ করে মনে হয় যে, শ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বা দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আর কিছু সমস্যা দেখা যায়, যার প্রভাবে তাদের হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। যেমন কারও কারও শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যাটা আরো জটিল হয়। কোভিড ভালো হয়ে যায়, জ্বর আর থাকে না। কিন্তু কারো কারো ফুসফুসে পরিবর্তন হয় এবং জটিলতা দেখা দেয়। আবার কেউ হার্টের সমস্যায় পড়েন। হার্ট ফেইলিউরও হয়। অনেক সময় হঠাৎ কার্ডিয়াক ডেথও হয়ে যায়। হার্টের রিদমেরও সমস্যা হয়, হার্টবিট কখনো স্লো হয়ে যায় বা খুব বেড়ে যায়। এ ছাড়া অনেকের ভুলে যাওয়ার বিষয়টা বেড়ে যায়।
করোনা-পরবর্তী ফলোআপ ক্লিনিক চালু প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. জুলফিকার আহমেদ আমিন বলেন, ‘চিকিৎসায় করোনা ভাইরাস থেকে মুক্ত হলেও অন্যান্য শারীরিক জটিলতা কিছুটা থেকে যায়। কোভিড-১৯ আক্রান্ত ব্যক্তি হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পাওয়ার পর স্বাভাবিক জীবনযাপন শুরু করতে পারেন। তার শরীরে জীবাণু না থাকায় অন্যরা তখন আর ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না। কিন্তু অন্যান্য শারীরিক জটিলতার কারণে তিনি নিজে যন্ত্রণায় ভুগতে পারেন।’ তিনি বলেন, ‘হৃদরোগ, ইউরোলজি, স্নায়ুতন্ত্রের বিভিন্ন সমস্যা এ সময় দেখা দিতে পারে। তার মানে করোনা নেগেটিভ হলেও তিনি যে শতভাগ ভালো হয়ে গেলেন, তা কিন্তু নয়। অন্যান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কিছু কিছু থেকে যেতে পারে। তখন ওই রোগীর কী হবে? সেই চিন্তা থেকেই আমরা এ ব্যবস্থা নিয়েছি।’ তিনি আরো বলেন, ‘করোনা আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার পর যারা বাড়ি যাচ্ছেন, তারা আবার নানা ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যায় পড়ছেন। কিছু সমস্যা নতুন করে দেখা যাচ্ছে। এ জন্য তারা কষ্টের মধ্যে থাকেন। এসব চিন্তা করেই আমরা এই ক্লিনিকটি চালু করেছি। এখন আপাতত আমরা দুদিন রোগীদের চিকিৎসা দেব। যদি দেখি রোগীর সংখ্যা বাড়ছে তাহলে সপ্তাহের বাকি দিনগুলোয়ও রোগী দেখার ব্যবস্থা করব।’